মীর মশাররফ হোসেনের (১৮৪৭-১৯১১) বিষাদ-সিন্ধু (১৮৯১) বাংলা
উপন্যাসসাহিত্যের ধারায় এক কালজয়ী সৃষ্টিকর্ম। শতবর্ষেরও অধিককাল পূর্বে
প্রকাশিত এই উপন্যাস এখনো বাংলাভাষী সাহিত্য পিপাসুদের কাছে একটি অনুপম
গ্রন্থ হিশেবে বিবেচিত। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যে-সব গ্রন্থ জনপ্রিয়তায়
শতাব্দীর সীমা অতিক্রম করেছে, বিষাদ-সিন্ধু নিঃসন্দেহে তার অন্যতম। হিজরি
৬১ সালের মহরম মাসে সংঘটিত কারবালার মর্মন্তুদ কাহিনী অবলম্বনে রচিত হয়েছে
বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাস।
কাহিনী-উৎস যা-ই হোক, ইতিহাসের সত্যকে মহাকাব্যিক
বিশালতায় রূপদান করার মধ্যেই মীর মশাররফ হোসেনের ব্যতিক্রমী শিল্পচেতনার
পরিচয় সুপরিস্ফুট। ইতিহাসের সত্যকে শিল্পের সত্যে রূপান্তরণের কারণেই তিনি
অর্জন করেছেন কালোত্তীর্ণ সিদ্ধি। এই উপন্যাসে, মীর মশাররফ হোসেন, ইতিহাসকে
অবলম্বন করে নির্মাণ করেছন মানবিক-সম্ভাবনার শাশ্বত শব্দভাষ্য—এখানে তিনি
‘ইতিহাসের দাস নন, শিল্পের বশ’। পুঁথিসাহিত্যকেন্দ্রিক ইতিহাস-অবলম্বী
বিষাদ-সিন্ধু স্রষ্টার ব্যতিক্রমী প্রতিভার স্পর্শে এভাবে হয়ে উঠেছে মানবিক
মহিমা ও সম্ভাবনার শব্দ-প্রতিমা।
নাটকীয় সংঘাত, আকস্মিকতা, চরিত্রের আভ্যন্তর দ্বন্দ্ব এবং সংলাপরীতির আশ্রয় বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসের প্রধান শিল্পবৈশিষ্ট্য। রূপতৃষ্ণা, ঈর্ষা, নাটকীয়তা, ধর্মীয় মূল্যবোধে গভীর বিশ্বাস—এইসব প্রবণতা মীর মশাররফ হোসেনের চরিত্রায়ণ-কৌশলের মৌল-ভিত্তি। এই প্রবণতাগুলো অবলম্বন করেই মীর মশাররফ হোসেন নির্মাণ করেছেন বিষাদ-সিন্ধু-র গৌণ-মুখ্য চরিত্ররাশি। বিষাদ-সিন্ধু-র প্রধান চরিত্র এজিদ, সে-ই এ-উপন্যাসের নায়ক। মশাররফ হোসেনের মানবনিষ্ঠা ও সাহিত্যিক অভিরুচি প্রধানত এজিদ-চরিত্রকে কেন্দ্র করেই অভিব্যক্ত।
ঔপন্যাসিক হিশেবে মীর মশাররফ হোসেনের স্বাতন্ত্র্য এই যে, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনুন্নত মুসলিমসমাজ থেকে আবির্ভূত হওয়া সত্ত্বেও প্রথম থেকেই তিনি সৃজনশীল সাহিত্যের মানবতাবাদী মৌল ধারাটির সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসের বিষয়স্বাতন্ত্র্য ও শিল্পচারিত্র্য পর্যালোচনা করলে এ-সত্যই আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়। বিষাদ-সিন্ধু, যথার্থ অর্থেই, বাংলা উপন্যাসের ধারায় এক স্বতন্ত্র, অনুপম ও অনতিক্রান্ত উপন্যাস।